দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে প্রয়োজনীয় শর্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ

স্টাফ রিপোর্টার:মো: সেলিম রানা দেবিদ্বার,কুমিল্লা

বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি কঠিন সমস্যা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যমান। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দুর্নীতি নির্মূল করা অত্যন্ত জরুরি। এই প্রতিবেদনটি প্রস্তাব করবে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত এবং কার্যকর পদক্ষেপ যা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।

১. আইন ও নীতির কঠোর বাস্তবায়ন
দুর্নীতি প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো কঠোর আইন এবং নীতির বাস্তবায়ন। দেশের সকল স্তরে দুর্নীতি দমন আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা আবশ্যক। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সঠিক এবং কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে প্রশাসন এবং সরকারি কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব। যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি প্রমাণিত হয় দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তবে তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে।

২. স্বচ্ছ প্রশাসন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া
প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। সকল সরকারি কার্যক্রমে তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় স্তর পর্যন্ত জনসম্মুখে সমস্ত তথ্য প্রকাশ করতে হবে। সরকারি প্রকল্প, বরাদ্দ, এবং কর্মসূচির বিষয়ে সঠিক তথ্য প্রদান করতে হবে যাতে জনগণ অনায়াসে তা অনুসরণ এবং যাচাই করতে পারে। উন্নত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এটি দুর্নীতির অভিযোগ বা অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং তদন্তের ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে।

৩. শক্তিশালী নজরদারি এবং অডিট ব্যবস্থা
দুর্নীতি কমানোর জন্য একটি শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার এবং সংস্থাগুলোর সমস্ত খরচ এবং আয় নিয়মিতভাবে অডিট করতে হবে। জনগণকে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের অডিট ফলাফল সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। সরকারি কর্মচারী এবং রাজনৈতিক নেতাদের সম্পদের উৎস সম্পর্কিত জিজ্ঞাসা এবং পর্যালোচনা নিয়মিতভাবে পরিচালনা করতে হবে।

৪. দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যকর ভূমিকা
দুর্নীতি দমন কমিশন (ACC) যদি পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তাহলে দুর্নীতি প্রতিরোধে বড় ধরনের অগ্রগতি হতে পারে। এই কমিশনের কার্যক্রমে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব থাকা উচিত নয়। কমিশনকে দুর্নীতির তদন্ত এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে পুরোদমে সক্রিয় থাকতে হবে। কমিশনের দক্ষতা এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে আরও প্রয়োজনীয় সুধারণা আনতে হবে।

৫. রাজনৈতিক নেতাদের স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধ
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দুর্নীতির প্রতি অঙ্গীকার এবং দায়িত্ববোধ থাকা উচিত। জনগণের সেবা করার জন্য নির্বাচিত নেতা এবং কর্মকর্তাদের উচিত সৎভাবে কাজ করা। রাজনৈতিক ক্ষমতা অপব্যবহার এবং স্বার্থের সংঘর্ষ রোধ করতে স্বচ্ছ এবং নৈতিক নেতৃত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ। জনপ্রতিনিধিদের স্বচ্ছতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে।

৬. শিক্ষা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি
দুর্নীতি প্রতিরোধে জনসচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। সাধারণ জনগণের মধ্যে দুর্নীতির ক্ষতিকর প্রভাব এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থা এবং মিডিয়ার মাধ্যমে দুর্নীতি সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা এবং পরবর্তী প্রজন্মকে সৎ, নৈতিক এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে তৈরি করা যেতে পারে।

৭. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
দুর্নীতি আন্তর্জাতিক একটি সমস্যা এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব। দেশীয় সরকার শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে না, তাদের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো এবং মনিটরিং সিস্টেমের মাধ্যমে দেশীয় দুর্নীতির পরিমাণ কমানো সম্ভব।

৮. সুশীল সমাজের ভূমিকা
সুশীল সমাজের সংস্থাগুলোর অগ্রণী ভূমিকা থাকা উচিত দুর্নীতি প্রতিরোধে। বিভিন্ন এনজিও এবং সামাজিক সংগঠনকে সুশাসন এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আরও উৎসাহিত করতে হবে। এগুলো যেন সরকার এবং জনগণের মাঝে দুর্নীতি প্রতিরোধে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

৯. তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার
তথ্য প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে সরকারের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব। অনলাইনে সরকারি প্রকল্পের তথ্য, খরচ, এবং ব্যয়ের হিসাব প্রাপ্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি কমিয়ে আনা সম্ভব, বিশেষ করে লেনদেনের ক্ষেত্রে যেগুলো আগের তুলনায় আরো দ্রুত, সঠিক এবং স্বচ্ছ হবে।

১০. জনগণের অংশগ্রহণ
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণ যদি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রতিবাদ করে এবং সচেতন থাকে, তবে সরকারকে বাধ্য হতে হবে তাদের কার্যক্রম স্বচ্ছ করতে। জনগণের কাছে দুর্নীতি বিরোধী পরামর্শ এবং অভিযোগ দাখিল করার একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

উপসংহার
দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা হলেও এর বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করলে একটি সৎ, স্বচ্ছ এবং উন্নত সমাজ গঠন করা সম্ভব। শক্তিশালী আইন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব। দেশের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি, দৃঢ় পদক্ষেপ এবং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে, যা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি শুদ্ধ, ন্যায্য এবং সমৃদ্ধ সমাজ তৈরি করবে।
লেখক: মো: সেলিম রানা (সাংবাদিক)
সম্পাদক ও প্রকাশক : মো: শাহজাহান বাশার
কুড়াখাল পূর্ব পাড়া দেবিদ্বার কুমিল্লা
মোবাইল : ০১৬৭৪৫২২০৯৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *