আমার আব্বু— এম.আমিনুল হক

মোঃ এহতেশামুল হক (অনুবাদ)।
২১ শে এপ্রিল,২০২৫!
আমার আব্বু এম.আমিনুল হকের মৃত্যুর ছয় বছর পূর্ণ হলো। আমার আব্বুর জীবন বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামের উত্তাল পথের প্রতিধ্বনি।

এবার প্রথমবার আমাদের পরিবার ও গোদাগাড়ী-তানোরের প্রিয় মানুষজনসহ একটি স্বাধীন ও গনতান্ত্রিক বাংলাদেশে আব্বুর স্মৃতি স্মরণ করছে।

ঊনসত্তরের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের কারণে রাজশাহীতে আব্বুর বিরুদ্ধে নয়টি মামলা হয়েছিল। পাকিস্তানি আমলে পাক-সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে আব্বু দেশ ত্যাগ করে লন্ডনে ব্যারিস্টারী পড়তে যান।

কয়েক দশক পরে,২০০৭-এ আব্বু (আমিনুল হক) পুনরায় জেনারেল মঈন উদ্দিন আহমদের মিলিটারি ব্যাক সরকারের রোষানলে পড়েন। বাংলাদেশে আব্বুর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য প্রণোদিত অভিযোগের ফলে আব্বুর (আমিনুল হক) অনুপস্থিতিতে তাঁর বিরুদ্ধে ৩৪ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। পরে হাইকোর্ট এই রায় বাতিল করে দেন।

সেই নির্বাসিত দুঃসময়ে আব্বু আমেরিকা সরকারের National Prayer Breakfast hosted by তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে আমেরিকায় ব্রেকফাস্ট প্রেয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দেন। উল্লেখ্য, ব্রেকফাস্ট প্রেয়ারের পূর্বেও তিনি প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন এবং ক্লিনটনের সময়কাল ছাড়াও আরও কয়েকবার যোগ দেবার সুযোগ পেয়েছেন।

২০১৮ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় আমার আব্বুর (আমিনুল হক) উপর যে ক্ষতি হয়েছিল তা নির্বাচনী ছবি ও ভিডিও ফুটেজে ফুটে উঠেছে।

শারীরিক চাপের চেয়েও আব্বুর জন্য সবচেয়ে কঠিন ছিল নিজ হাতে গড়া সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবক্ষয় দেখে যাওয়া,যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনি রক্ষা করার জন্য আজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।

উদার গণতন্ত্র এবং প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির শক্তিতে দৃঢ় বিশ্বাসী আমার আব্বু বিচার বিভাগ এবং বেসামরিক প্রশাসনের উপরে অগাধ ও অপার বিশ্বাস রাখতেন। দলীয় ক্ষমতার সেবায় এই সংস্থাগুলোকে দমন পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখাটা আব্বুর জন্য গভীর বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা।

আর্মি বা সামরিক ব্যাক সরকারের হাতে আব্বু দেশে স্বৈরশাসন ও একদলীয় নিপীড়নের মধ্যে পড়েন। পরবর্তী জীবনটা প্রকৃত অর্থে নিজের মামলা,এলাকার মামলা এবং দলীয় মামলাগুলো নিয়ে বিশেষ করে দলীয় মামলার কোন পরিসংখ্যান ছিল না। এর সাথে শুরু হয় পলাতক জীবন। প্রায় নিত্য নৈমত্তিক বিষয় হয়ে যায় ঠিকানা পরিবর্তন ও আত্মগোপনে থাকা। এই আত্মগোপনে উনার মতন সবাই নিজেও বিপদ নিয়ে ঘুরতেন। যে বাসায় আশ্রয় নিতেন তারাও বিপদগ্রস্ত হতেন। উনাকে না পাওয়াতে পরিবারও জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতেন এবং সবসময় আতংক ও বিপদ নিয়ে অনিশ্চয়তায় জীবন পার হতো। যা তিনি এবং তার দলকে (বিএনপিকে) নিঃশেষ করে দেয়ার নীল নকশা বলা যায়।

ক্রমশ বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনিশ্চিত জীবন ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে অসুস্থতা আব্বুকে ঘিরে ধরে।

কিন্তু বাস্তবে দেশ ও রাজনীতি পাগল এই মানুষটি নিজের শরীর নয়,দেশ, রাজনীতি ও আদালতে ন্যায়ের পক্ষে থাকাটাই জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নেন।

২০১৮-তে আব্বু জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে মনোস্থ করেন। এই নির্বাচন—যা রাষ্ট্র প্রসারিত ব্যাপক দমন- নিপীড়নের ছিল।

মূলত স্বৈরশাসকের অধীনে প্রতিটি নির্বাচনের মতন ২০১৮ সালের নির্বাচন ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বেদনার এক বিরাট দুঃসময় হিসাবে উল্লেখ্য— যা ব্যাপকভাবে রাষ্ট্র,আদালত,প্রশাসন,দমন পীড়ন ও নির্যাতনের উদাহরণ ছিলো।

পুলিশসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করবার জন্য ব্যাপকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে। যার ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের অনন্য ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতার সাথে তুলনা করা হয়েছিল। পলাশীতে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ইয়াহিয়া খানের কর্মকান্ড পর্যন্ত।

রাজশাহী-১ আসনে আব্বুর প্রচারনা এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল যা পুরোটাই তাঁর প্রতিকূলে ছিল। একসময়ের অবকাঠামোর (রাস্তা ও যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা) মডেল হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চলের রাস্তা-ঘাট ২০১৮ সালের মধ্যে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ভাঙাচোরা,জোড়া-তালি দেয়া রাস্তায় পরিনত হয়েছিল এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামে পৌঁছানোর জন্য মটর সাইকেল ও পায়ে হাঁটার প্রতি নির্ভর করতে হতো।

নির্বাচনটি নিজেই প্রকাশ্যে হুমকি হয়ে উঠেছিলো।ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবীদরা সিনেমার প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিলেন মনে হয়। ভোটের আগের রাতে আমাদের পারিবারিক বাসভবনের সামনে মিছিল করেছিলো। সরকারি প্রচারনার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে বিরোধী দলীয় নেতা নিজ হাতে আব্বুর (আমিনুল হক) ছবি ও পোষ্টার ছিড়েছিলেন। এখানে ওমর ফারুকের বহুল প্রচারিত লাঠিসহ ভিডিওটি উল্লেখ্য।

আগের কয় রাত থেকেই পুলিশ আব্বুকে এ্যারেস্ট করবার জন্য অভিযান চালান এবং ফোন কল রেকর্ড করে। আমার আব্বু (আমিনুল হক) গোদাগাড়ীতে আম বাগানের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন। সেই বাসায় প্রশাসনের লোকজন পৌছান এবং বাড়ীর প্রতিটি অংশসহ ভাড়া দেয়া অংশ ফোর্সসহ তন্নতন্ন করে খোঁজ করেন।

থানার প্রধান যে আঙিনায় দাঁড়িয়ে ফোর্সকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন তার পাশেই গোলা ঘরে আব্বু (আমিনুল হক) অবস্থান করছিলেন এবং ঘর বাইরে থেকে তালা দেয়া ছিল এবং সামনে অনেক বস্তা রাখা ছিলো। কয়েক ঘন্টা খোঁজার পর তারা ফিরে যান

২০১৮ সালের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে রক্তপাতের ঘটনা ঘটে। এমন কয়েকটি আসনের মধ্যে রাজশাহী-১ ছিল। তৎকালীন শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাসে দরবার হলে সংসদীয় শপথ গ্রহনের সময় প্রকাশ্যে আমার আব্বুর বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ দায়েরের হুমকি দিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় আব্বুর শারীরিক প্রতিকূল অবস্থার অবনতি ঘটে।
ধারণা করা হয়—এই দুটি হত্যার সাথে বিএনপি এবং স্থানীয় প্রার্থীর ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত করবার জন্য তাদের ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল।

মানসিক ও অনৈতিক দোষারোপ এবং সেই সাথে মামলার চাপ ও থ্রেটের ভিতর থাকতে থাকতে আব্বু ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে টা থেকে পরে স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতে পারেন নি।

আব্বুর পরিবার এবং আরও অনেকের জন্য আমার আব্বুর আত্মত্যাগও একটি গভীর ব্যক্তিগত ক্ষতি এবং বৃহত্তর জাতীয় হিসাবের একটি অধ্যায় হিসাবে দাড়িয়ে আছে —ভিন্ন মতকে নীরব করবার মূল্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *