না ফেরার দেশে সংগীত সাধকের বিদায়: মুস্তাফা জামান আব্বাসীর মহাপ্রস্থান

মোঃ মকবুলার রহমান স্টাফ রিপোর্টার নীলফামারী

বরেণ্য সংগীতজ্ঞ, গবেষক ও প্রাজ্ঞ লেখক ড. মুস্তাফা জামান আব্বাসী আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ১০ মে, শনিবার সকালে ঢাকার বনানীর একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। শেষবারের মতো হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন শুক্রবার সন্ধ্যায়, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে। শনিবার ভোরে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন কন্যা শারমিনী আব্বাসী।

ড. মুস্তাফা জামান আব্বাসীর জীবন ছিল সংগীত, সাহিত্য ও গবেষণার এক অনুপম ধারা। ১৯৩৬ সালের ৮ ডিসেম্বর ভারতের কোচবিহার জেলার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সংগীত কিংবদন্তি আব্বাসউদ্দীন আহমেদের সুযোগ্য পুত্র তিনি। ছোটবেলা কেটেছে কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৫৯ সালে বিএ অনার্স ও পরের বছর এমএ সম্পন্ন করেন।

তাঁর সংগীতসাধনার পথচলা কেবল মঞ্চেই সীমাবদ্ধ ছিল না; রেডিও, টেলিভিশন, গবেষণাগার এবং কলামেও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। বাংলা লোকসংগীতের গবেষণায় তিনি রেখে গেছেন অমর অবদান। পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, চটকা কিংবা নজরুলগীতি—সব ধারাতেই ছিল তাঁর দক্ষতা ও একান্ত ভালোবাসা।

বহু দেশ সফর করে বাংলাদেশকে সংগীতের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন তিনি। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে সগৌরবে অংশগ্রহণ করেন। ইউনেস্কোর আওতায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিটি অব মিউজিকের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন টানা এক যুগ। ফোক মিউজিক রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক হিসেবে তাঁর সংগ্রহে ছিল কয়েক হাজার মূল্যবান লোকগীতি।

তিনি ‘লোকসংগীতের ইতিহাস’, ‘ভাওয়াইয়ার জন্মভূমি’, ‘ভাটির দ্যাশের ভাটিয়ালি’সহ ২১টি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি’ ও ‘স্বাধীনতা দিনের গান’ সংকলন দুইটি সংস্কৃতিসেবীদের কাছে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত।

সাহিত্য, সংগীত ও গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি একুশে পদকসহ বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন—যার মধ্যে রয়েছে শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, লালন পদক, আব্বাসউদ্দিন স্বর্ণপদক, নজরুল একাডেমি পুরস্কার প্রভৃতি।

ড. মুস্তাফা জামান আব্বাসী কেবল এক সংগীতজ্ঞ নন, তিনি ছিলেন এক বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি নিজ জীবনের মাধ্যমে বাংলা সংগীত ও সাহিত্যের ঐতিহ্যকে যুগ থেকে যুগান্তরে পৌঁছে দিয়েছেন বাতিঘরকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *