
মোঃ ইদ্রিস আলী,
ক্রাইম রিপোর্টার,
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার একটি নিভৃত গ্রাম নাকোবাড়িয়ায় গত ১ জুন যে রক্তাক্ত সংঘর্ষে দুই সহোদরের মৃত্যু হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে স্থানীয় রাজনীতির বহুদিনের পুরনো ক্ষত। বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং আধিপত্য বিস্তারের সংগ্রাম—এই সব কিছুর জটিল মিশ্রণেই তৈরি হয়েছে এমন এক বিস্ফোরণ, যার বলি হলেন মহব্বত হোসেন (৬২) ও তার ছোট ভাই ইউনুছ আলী (৫৫)।
সংঘর্ষের দিন কী ঘটেছিল?
১ জুন দুপুরের দিকে জামাল ইউনিয়নের নাকোবাড়িয়া গ্রামে বিএনপির স্থানীয় দুটি গ্রুপের মধ্যে প্রথমে কথাকাটাকাটি, পরে হাতাহাতি এবং একপর্যায়ে ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, দুই পক্ষই সংগঠিত হয়ে হামলা চালায়।
সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই নিহত হন মহব্বত হোসেন। গুরুতর আহত হন তার ভাই ইউনুছ আলী, যাকে প্রথমে যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়,পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় পাঠানো হয় ঢাকা ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ৪ জুন ভোররাতে মারা যান।
আহত ও ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের আরও অন্তত পাঁচজন গুরুতর আহত হয়েছেন। সংঘর্ষ চলাকালীন বেশ কয়েকটি বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। এলাকাবাসীর দাবি, সংঘর্ষের সময় পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে বিলম্ব করেছে, ফলে সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
হত্যা মামলা, গ্রেফতার ও রাজনৈতিক পাল্টা প্রতিক্রিয়া
২ জুন নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে কালীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় থানা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা নুরুল ইসলাম সহ মোট ৫৮ জনকে আসামি করা হয়। মামলার পর থেকে এলাকায় টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে।
থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শহিদুল ইসলাম হাওলাদার জানান, মামলার ভিত্তিতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
অন্যদিকে, মামলায় দলীয় নেতা নুরুল ইসলামের নাম অন্তর্ভুক্ত করায় বিএনপির একাংশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ৩ জুন রাতে কালীগঞ্জ শহরে তারা বিক্ষোভ মিছিল ও থানা ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে। বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করেন,এই মামলায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে নিরপরাধদের জড়ানো হয়েছে।
দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক কোন্দলের ইতিহাস
কালীগঞ্জ উপজেলা বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। বিগত দশকে দলের স্থানীয় নেতৃত্বে একাধিকবার বিভাজন ও গ্রুপিং স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদিকে রয়েছে জেলা ও থানা পর্যায়ে প্রভাবশালী নেতাদের নেতৃত্বে গড়া একটি, অন্যদিকে তৃণমূলের অনেক কর্মী-সমর্থক রয়েছে আরেকটি ভিন্ন বলয়ে।
দলীয় মনোনয়ন, ইউনিয়ন কমিটি গঠন, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সফরকে ঘিরে দায়িত্ব ভাগাভাগি, এমনকি আন্দোলনের পদ্ধতি নিয়েও বারবার ভিন্নমত প্রকাশ পেয়েছে। এতে সংগঠনের কার্যক্রমেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
পরিবার ও গ্রামবাসীর অভিমত
নিহতদের পরিবারের দাবি, এই হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত। তাদের ভাষায়, আমরা বিএনপির লোক, কিন্তু সেই পরিচয়েও আমাদের রক্ষা হয়নি। যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের সবার নাম মামলায় দেওয়া হয়েছে। এখানে কাউকে রাজনৈতিক কারণে জড়ানো হয়নি।
অন্যদিকে, স্থানীয় কিছু বাসিন্দা জানান, যারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, তারা নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতেই সাধারণ কর্মীদের ব্যবহার করছে। দুই পক্ষই সহিংসতার জন্য প্রস্তুত ছিল।
পুলিশ প্রশাসনের অবস্থান
পুলিশ বলছে, পরিস্থিতি শান্ত রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ওসি শহিদুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, আমরা কোনো পক্ষ নিচ্ছি না। যারা দোষী তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তদন্ত সুষ্ঠুভাবে চলছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থানীয় কোন্দল অনেক সময় কেন্দ্রীয় রাজনীতির প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। কালীগঞ্জের ঘটনাও সেই বাস্তবতার অংশ। রাজনৈতিক সহনশীলতা না থাকলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি অব্যাহত থাকবে।