
সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার- জাহারুল ইসলাম জীবন
মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। ইসরায়েলের নজিরবিহীন বিমান ও ড্রোন হামলার কঠোর জবাব দিতে শুরু করেছে ইরান। গত শুক্রবার (১৩ জুন ২০২৪) ইসরায়েল ইরানজুড়ে পাঁচ ধাপে শত শত হামলা চালিয়ে অন্তত আটটি শহরে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। এই হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ডের প্রধান হোসেইন সালামি নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে, যা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। এই হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইরান ইসরায়েলের ওপর ব্যাপক হামলা শুরু করেছে, যা মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের শঙ্কা তৈরি করেছে।
ইসরায়েলের সামরিক প্রস্তুতি ও সতর্কতাঃ-
ইসরায়েলের সেনাপ্রধান আইয়াল জামির টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে জানিয়েছেন, তাঁর সেনাবাহিনী “১০ হাজারের বেশি সৈন্য মোতায়েন করছে এবং সব সীমান্তজুড়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে।” তিনি সতর্ক করে বলেছেন, “যে কেউ আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে চাইবে, তাকে বড় মূল্য দিতে হবে।” জামির আরও বলেন, “ইসরায়েলের জনগণ, আমি সম্পূর্ণ সাফল্যের নিশ্চয়তা দিতে পারি না। ইরানি শাসকগোষ্ঠী প্রতিশোধ নিতে আমাদের ওপর হামলার চেষ্টা করবে। এ হামলার সম্ভাব্য মূল্য আমাদের আগের অভিজ্ঞতা থেকে আলাদা হবে।” তিনি জানান, “আমরা এ অভিযানের প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই নিচ্ছি। বাস্তব ও তাৎক্ষণিক হুমকির বিরুদ্ধে প্রস্তুতির জন্য সেনাবাহিনীর সব শাখা ও বিভাগ মিলিয়ে নজিরবিহীন চেষ্টা চালানো হয়েছে।” ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরও জানিয়েছে, ২০১৪ সালের যুদ্ধ নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে গ্রহণ করা ‘শিক্ষার বাস্তবায়ন’ করছে তারা।
ইরানের কঠোর জবাবের অঙ্গীকারঃ-
এদিকে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাসহ দেশটির বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলের প্রাণঘাতী হামলার কঠোর জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে তেহরান। ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের মুখপাত্র আবুলফজল শেখারচি বলেন, “জায়নবাদী এ হামলার জবাব অবশ্যই ইরানি সশস্ত্র বাহিনী দেবে।” তিনি আরও বলেন, “ইসরায়েলকে তার হামলার চড়া মূল্য দিতে হবে এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর কঠোর জবাবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।” ইরানের সংবাদমাধ্যমগুলো তেহরানজুড়ে ৬ থেকে ৯টি বিস্ফোরণের শব্দ শোনার খবর দিয়েছে, যার মধ্যে আবাসিক ভবনেও হামলা হয়েছে।
নেতানিয়াহুর ‘পলায়ন’ গুঞ্জনঃ-
ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ইরানের ড্রোন হামলার কয়েক ঘণ্টা পর আজ শুক্রবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারি উড়োজাহাজ এথেন্সের বিমানবন্দরে দেখা গেছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়েছে নেতানিয়াহুর ‘পালিয়ে যাওয়ার’ গুঞ্জন। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ড এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে। উড়োজাহাজ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ফ্লাইট রাডার টুয়েন্টি ফোরের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের ব্যবহারকারীরা নেতানিয়াহুর উড়োজাহাজের ফ্লাইটের রুট, সময় এবং গ্রিসে শেষ অবতরণ ট্র্যাক করার দাবি করেছেন। তাঁদের মতে, নেতানিয়াহুকে বহনকারী উড়োজাহাজ ‘উইং অফ জিওন’ আজ শুক্রবার বিকেলে এথেন্স বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে। যদিও উড়োজাহাজটিতে নেতানিয়াহু কিংবা তাঁর পরিবারের কেউ ছিলেন কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি এবং নেতানিয়াহুর বর্তমান অবস্থান সম্পর্কেও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ কিছু জানায়নি। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, নিরাপত্তা সতর্কতার অংশ হিসেবে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ হয়তো দেশটির শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের জন্য এই ব্যবস্থা নিয়েছে। অন্যদিকে, ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ইরনা দাবি করেছে, তেহরানে হামলার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে অজ্ঞাত কোনো স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁকে গ্রিসে নেওয়া হয়েছে।
‘অপারেশন রাইসিং লায়ন’ এবং জরুরি অবস্থাঃ-
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, আজ ভোরে ‘অপারেশন রাইসিং লায়ন’ নাম দিয়ে তেহরানে হামলা চালায় ইসরায়েল। দেশটির সেনাবাহিনী বলেছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ব্যর্থ করে দিতেই তারা এই হামলা চালিয়েছে। এ হামলার প্রতিক্রিয়ায় পরে ইসরায়েলে ১০০টি ড্রোন সহ বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান। সার্বিক পরিস্থিতিতে ইসরায়েলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে।
নেতানিয়াহু ও খামেনির কঠোর বার্তাঃ-
হামলা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেছেন, হামলা যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণই চালানো হবে। হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান কঠোর বার্তা দিয়েছে। দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ‘তিক্ত ও যন্ত্রণাদায়ক’ পরিণতির জন্য ইসরায়েলকে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন।
আমেরিকার অবস্থান:-
হামলার পেছনে আমেরিকার কোনো হাত নেই দাবি করে ইসরায়েলের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘ইরান যদি প্রতিশোধ নেয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে।’
এই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করেছে। ইসরায়েল এবং ইরান উভয় পক্ষই সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং একে অপরের উপর পাল্টা বড় ধরনের হামলার হুমকি দিচ্ছে। বিপ্লবী গার্ডের প্রধান হোসেইন সালামির মৃত্যু ইরানের প্রতিশোধমূলক কার্যক্রমকে আরও তীব্র করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে চলমান এই হামলা-পাল্টা হামলার ফলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।