সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার- জাহারুল ইসলাম জীবন
মধ্যপ্রাচ্যে এখন চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। আমেরিকা, ইসরায়েল এবং ইরান-সমর্থিত বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির মধ্যেকার দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলে সামরিক মহড়া, একে অপরের দিকে স্থল ও যুদ্ধ রকেট নিক্ষেপ এবং বিমান হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। ফিলিস্তিনের গাজা থেকে শুরু করে সিরিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে সংঘাতের আগুন জ্বলছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, মধ্যপ্রাচ্যের এই ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা কি কেবলই আধিপত্য বিস্তারের লড়াই, নাকি এটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হতে চলেছে?
ইসরায়েল এবং তার মিত্রদের বিরুদ্ধে একের পর এক মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ উঠছে। গাজায় দীর্ঘদিনের অবরোধ এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নির্বিচারে বোমা হামলা আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। নারী, শিশুসহ সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ। বিশ্ব বিবেক যেন আজ নীরব দর্শক। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হয়ে ফিলিস্তিনের মানুষ খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সামান্য যে সাহায্য আসছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
মানবতার ধ্বজাধারীরা আজ মুখ বন্ধ করে রেখেছে। মানবতাবিরোধী এই অপরাধযজ্ঞ যেন দেখার বা প্রতিবাদ করার কেউ নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা এবং কার্যকর পদক্ষেপের অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সংঘাতের মূল কারণ হিসেবে বলতে গেলে বলতেই হয় মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতির পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হলো আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ইরান ও তার মিত্রদের (যেমন হিজবুল্লাহ, হামাস) সঙ্গে ইসরায়েল এবং তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক আমেরিকার দীর্ঘদিনের সংঘাত। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা ইসরায়েল ও আমেরিকাকে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। অন্যদিকে, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত এই অঞ্চলের একটি দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত, যা সময়ে সময়ে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিরিয়া, ইয়েমেন এবং লেবাননের মতো দেশগুলোতে Proxy War বা ছায়া যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা গেছে, যেখানে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো স্থানীয় বিভিন্ন পক্ষকে সমর্থন জুগিয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। এর ফলে একদিকে যেমন দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে, তেমনি আঞ্চলিক উত্তেজনাও বাড়ছে।
সাম্প্রতিক উত্তেজনার চিত্রে দেখা যাচ্ছে গত কয়েক মাসে মধ্যপ্রাচ্যে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছেঃ-
** গাজায় ক্রমবর্ধমান সংঘাতঃ ইসরায়েলি বাহিনীর ঘন ঘন অভিযান এবং ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর রকেট হামলা অব্যাহত রয়েছে। এতে বহু বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানি ঘটছে এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
** সিরিয়ায় বিমান হামলা: ইসরায়েল প্রায়শই সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর অবস্থানে বিমান হামলা চালায়। ইরানও এর জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছে, যা সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
**সমুদ্রে উত্তেজনা: হরমুজ প্রণালী এবং লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলার ঘটনা বাড়ছে, যার পেছনে ইরান বা তার মিত্রদের সন্দেহ করা হচ্ছে।
**আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি: আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে এবং মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ মহড়া পরিচালনা করছে, যা ইরানকে আরও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
এমন উত্তেজনা কর পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় মধ্যপ্রাচ্যের এই ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে দ্রুত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে বলে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও সমর বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন। যদিও সরাসরি কোনো বৃহৎ আকারের যুদ্ধ এখনো শুরু হয়নি, তবে যেভাবে বিভিন্ন পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলো নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, তাতে একটি বড় ধরনের সংঘাতের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
যদি কোনো ভুল হিসাব বা একটি ছোট খাটো যুদ্ধের মহড়ার মতো পরিস্থিতি থেকেও বড় ধরনের সংঘাতের সূত্রপাত সংগঠিত হয়, তবে তা খুব দ্রুত আঞ্চলিক গণ্ডি ছাড়িয়ে যেতে পারে। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বিশ্ব শক্তিগুলোর এই অঞ্চলে নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে এবং তারা কোনো না কোনো পক্ষকে সমর্থন করছে। ফলে একটি বৃহত্তর সংঘাতের রূপ নেওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
মানবতার সর্বাধিক ও চরম বিপর্যস্ত মধ্যপ্রাচ্যের এই সংঘাতের সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধ ও অস্থিরতা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। খাদ্য, জল, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ চরম কষ্টে দিনাতিপাত করছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো সীমিত সম্পদ নিয়ে কাজ করে গেলেও, প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই নগণ্য।
বিশ্বের বিবেক আজ সত্যিই নীরব। শক্তিশালী দেশগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কাছে মানবতা যেন বন্দি হয়ে পড়েছে। নারী ও শিশুদের আর্তনাদ, ধ্বংসস্তূপের ছবি বিশ্বকে নাড়া দিলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
পরিশেষ প্রতিনিয়তই প্রতিমান হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ের নামে যা চলছে, তা আদতে মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল। বিশ্ব সম্প্রদায়কে এই পরিস্থিতিতে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। অবিলম্বে সংঘাত বন্ধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এবং অবরুদ্ধ মানুষের কাছে মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়া জরুরি। অন্যথায়, মধ্যপ্রাচ্যের এই আগুন শুধু এই অঞ্চলকেই নয়, গোটা বিশ্বকে একটি ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাস হয়তো এখনই দেওয়া সম্ভব নয়, তবে যেভাবে পরিস্থিতি মোড় নিচ্ছে, তাতে আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে বৈ কমছে না।
ইপেপার
সম্পাদক ও প্রকাশক ঃ মাহমুদুল হাসান মাহমুদ
বার্তা সম্পাদকঃ কে এম জাহিদ হাসান
প্রধান কার্যালয়ঃ ২৬৩/ফকিরাপুল, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০
www.dailyags.com © 2024