দৈনিক আজকের গোয়েন্দা সংবাদ
ক্রাইম রিপোর্টার, ঝিনাইদহ জেলা
মোঃ রুহুল আমিন
যারা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে গেছে তারাই ঘনঘন এখানে আসে।
প্যারিসের এক পুরোনো কবরস্থানে শুয়ে আছে একজন তরুণ, তার মূর্তির শরীরের বিশেষ অঙ্গে নারীরা দেয় হাজারো চুমু ও স্পর্শ। কথিত আছে, কেউ যদি তার ব্রোঞ্জ মূর্তির ঠোঁটে চুমু দেয়, হাতে ধরা টপ হ্যাটে ফুল রেখে যায় এবং প্যান্টের বিশেষ ভাঁজে স্পর্শ করে—তবে তার জীবনে নেমে আসবে ভালোবাসা, সন্তান, এমনকি বিয়ের সৌভাগ্য। অদ্ভুত হলেও সত্য, এই লোকবিশ্বাস শুধু কল্পকাহিনি নয়; এটি আজও হাজারো নারীকে টেনে আনে Père Lachaise কবরস্থানে, ফ্রান্সের সবচেয়ে বিখ্যাত সমাধিক্ষেত্রে।
কিন্তু এই মানুষটি কে ছিলেন? কীভাবে একটি কবর এতো গভীর সামাজিক অর্থবহন করতে পারে? চলুন ফিরে যাই ১৮৭০ সালের ফ্রান্সে—রাজনীতি, বিপ্লব, আর এক তরুণ সাংবাদিকের করুণ মৃত্যুতে।
ভিক্টর নোয়ারের প্রকৃত নাম ছিল ইভাঁ স্যালমন। জন্ম ১৮৪৮ সালের জুলাই মাসে, ফ্রান্সের আটিগনি নামক এক ছোট শহরে। কিশোর বয়সেই তিনি সাংবাদিকতার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং পরে “La Marseillaise” পত্রিকায় যোগ দেন, যা তৎকালীন ফরাসি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে কাজ করছিল। তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী, সাহসী এবং ন্যায়ের পক্ষে কলম ধরতে ভয় পাননি।
১৮৭০ সালের জানুয়ারিতে এক রাজনৈতিক অপমানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, নোয়ারকে পাঠানো হয় প্রিন্স পিয়ের বোনাপার্তের সঙ্গে দেখা করতে। উদ্দেশ্য ছিল একটি দ্বন্দ্বের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু সাক্ষাৎকারটা রক্তাক্ত রূপ নেয়। কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে প্রিন্স পিয়ের পকেট থেকে বন্দুক বের করে গুলি ছোড়েন—২২ বছর বয়সী নোয়ার ঘটনাস্থলেই মারা যান।
তার মৃত্যু যেন বারুদের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয় প্যারিসজুড়ে। জনতা ফুঁসে ওঠে, শোক মিশে যায় ক্ষোভে। ১ লাখের বেশি মানুষ তার শেষকৃত্যে অংশ নেয়। অনেকের চোখে তিনি তখন একজন শহিদ—সাম্রাজ্যবিরোধী সংগ্রামের প্রতীক।
দুই দশক পর, ১৮৯১ সালে, ভিক্টর নোয়ারের মৃতদেহ Père Lachaise কবরস্থানে স্থানান্তর করা হয়। তার সমাধির উপর নির্মিত হয় একটি বাস্তব-মাপের ব্রোঞ্জ মূর্তি, শিল্পী জুলস দালুর হাতে। এই মূর্তিটি এক নিঃশব্দ শ্রদ্ধাঞ্জলি—নোয়ারকে মৃত অবস্থায় শুইয়ে রাখা হয়েছে, চোখ বন্ধ, এক হাতে টপ হ্যাট ধরা।
কিন্তু এই মূর্তি সময়ের সাথে হয়ে ওঠে একেবারে ভিন্ন কিছু। দর্শনার্থীরা লক্ষ্য করতে শুরু করে যে মূর্তির প্যান্টের একটি অংশ—যেখানে যৌনাঙ্গের উদ্দীপনামূলক অবয়ব ফুটে উঠেছে—তা অন্য অংশের তুলনায় বেশি চকচকে, বেশি ঘষামাজা করা। এখান থেকেই জন্ম নেয় এক আজব কল্পকাহিনি: যারা প্রেমে ব্যর্থ, যারা মা হতে পারছেন না, যারা বিয়ের স্বপ্ন দেখেন—তারা যদি এই মূর্তির ঠোঁটে চুমু দেন এবং সেই নির্দিষ্ট স্থানে স্পর্শ করেন, তবে তাদের ভাগ্য বদলে যাবে।
লোককথাটি চাউর হতে দেরি হয়নি। ফরাসি নারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এক ভিন্নধর্মী আকর্ষণ: এক চুমুতে কী ভাগ্য বদলে যেতে পারে? হাজার হাজার নারী, দেশ–বিদেশের পর্যটকরা, এখন Père Lachaise-এ আসেন শুধুমাত্র এই একটাই উদ্দেশ্যে—ভিক্টর নোয়ারের মূর্তিকে চুমু দেওয়া, টপ হ্যাটে ফুল রাখা, এবং সেই ‘বিশেষ’ স্থানে স্পর্শ করা।
এই বিশ্বাস এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, ২০০৪ সালে কবরস্থানের কর্তৃপক্ষ সেই অংশে রেলিং বসিয়ে জনসাধারণের প্রবেশ সীমিত করতে চায়। কিন্তু এমন তীব্র প্রতিবাদ ওঠে—সংবাদপত্রে প্রতিবেদন, অনলাইন ক্যাম্পেইন, প্রকাশ্য বিক্ষোভ—যাতে কর্তৃপক্ষ সেই রেলিং সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এটি ছিল শুধু একটি মূর্তি নয়, বরং জন-মানসে স্থায়ী হয়ে ওঠা একটি মানসিক অভিজ্ঞতা, একটি সম্ভাবনার প্রতীক।
বহু সমাজবিজ্ঞানী ও মনস্তাত্ত্বিক এই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অনেকে একে দেখেন আধুনিক সমাজে নারীর ‘সৌভাগ্য’ নির্ভরতা বা সন্তান ধারণের চাপের প্রতীক হিসেবে—যেখানে একজন নারী বিশ্বাস করেন, তার জীবনের মূল সাফল্য নির্ভর করে একটি চুমু বা ছোঁয়ার ওপর।
আবার অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, এটি নারী–চেতনার এক প্রকার আত্মপ্রকাশ। এখানে নারী নিজেই ঠিক করেন—তিনি কী চান, কীভাবে চান, এবং কোথা থেকে চান। ভিক্টর নোয়ারের মূর্তি তাই হয়ে ওঠে একটি টোটেমিক প্রতীক—যেখানে নারীরা সামাজিক প্রথার বাইরে গিয়ে নিজের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন।
এমনকি কেউ কেউ বলেন, মূর্তির প্রতি এই আচরণ একটি “পরিবর্তিত পুরুষতন্ত্রের প্রতীক”—একজন পুরুষ, যিনি জীবিত নয়, যিনি প্রতিবাদ করতে পারবেন না, যার দেহ নারীর স্পর্শের প্রতীক্ষায় ‘অপেক্ষমাণ’। এতে পুরুষ-নারী সম্পর্কের ক্ষমতার ভারসাম্যও উল্টে যায়।
ভিক্টর নোয়ারের মূর্তিটি শুধু এক ব্রোঞ্জের শিল্পকর্ম নয়; এটি ইতিহাস, কল্পনা, প্রেম, যৌনতা ও আশা–সবকিছুর মিলনস্থল। একজন ২২ বছর বয়সী সাংবাদিক, যিনি গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন, তিনি আজ একজন পৌরাণিক চরিত্রে রূপান্তরিত।
তার কবর নিয়ে গড়ে উঠেছে শত শত ব্লগ, ডকুমেন্টারি, উপন্যাস, এমনকি শিল্প ইনস্টলেশন। এটি আমাদের শেখায়—মৃতদের গল্প শেষ হয় না, বরং তারা জীবিতদের কল্পনায় নতুন জীবন পায়।
ইপেপার
সম্পাদক ও প্রকাশক ঃ মাহমুদুল হাসান মাহমুদ
বার্তা সম্পাদকঃ কে এম জাহিদ হাসান
প্রধান কার্যালয়ঃ ২৬৩/ফকিরাপুল, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০
www.dailyags.com © 2024