রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার ডিআইজি প্রিজন্স কামাল হোসেনের যত অনিয়ম

বিশেষ প্রতিনিধি :
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইজি প্রিজন্স কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ গ্রহণ, বন্দীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়, অবৈধ সুবিধা প্রদান, এবং মাদক ও মোবাইল চোরাচালানের মতো গুরুতর অপরাধের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, তার খুঁটির জোর কোথায়?

মোবাইল চোরাচালান ও ঘুষ বাণিজ্য:-
কারা সূত্র জানায়, কারাগারের ভেতরে মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বন্দীদের কাছে ফোন পৌঁছে দেওয়া হয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি কারাগারের ‘২০ সেল’ থেকে ফাঁসির আসামি মতিন ও তারিকুলের কাছ থেকে দুটি দামি ফোন উদ্ধার হয়। অভিযোগ রয়েছে, এই মোবাইল চোরাচালান চক্রের মূল হোতা হলেন ডিআইজি প্রিজন্স কামাল হোসেন। কারারক্ষীদের মাধ্যমে তিনি এই অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

কারা অভ্যন্তরে গোপন খামার:-
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে সরকারি সম্পত্তি ব্যবহার করে ব্যক্তিগত ব্যবসা পরিচালনা করছেন কামাল হোসেন। তার নির্দেশে কারাগারের অভ্যন্তরে ‘গুরু ছাগলের খামার’ গড়ে তোলা হয়েছে, যা পুরোপুরি অবৈধ। বন্দীদের বিনা পারিশ্রমিকে এই খামারের কাজে ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও সেই খামারে কাজ করছেন দুই সুইপার। যার বেতন কারাকতৃপক্ষকে বহন করতে হয়।
বন্দীদের সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে বিশেষ সুবিধা:-
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে কামাল হোসেন বন্দীদের থেকে বড় অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করে তাদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে ধনী ও প্রভাবশালী বন্দীরা মোটা অঙ্কের টাকা দিলে তাদের জন্য থাকছে আরামদায়ক পরিবেশ, উন্নত খাবার, এবং ফোন ব্যবহারের অনুমতি।

বিভিন্ন জেল সুপারদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঘুষ আদায়:-
রাজশাহী কারাগারের ডিআইজি প্রিজন্স কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে বড় অংকের ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। রাজশাহী বিভাগের কারাগারসমূহ পরিদর্শনের নামে তিনি বিভিন্ন জেল সুপারদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঘুষ আদায় করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ডিআইজি কামাল হোসেন তার পরিদর্শনের সময় জেল সুপারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে অনৈতিক আর্থিক সুবিধা আদায় করেন। যদি কেউ তার এই অনৈতিক দাবির বিরুদ্ধে আপত্তি জানান, তবে তিনি তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অনিয়মের অভিযোগ এনে শাস্তিমূলক বদলির ব্যবস্থা করেন। এতে করে কারাগার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তার অনৈতিক দাবির বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পান না।
একজন জেল সুপারের ভাষ্যমতে, “ডিআইজি স্যারের দাবি পূরণ না করলে নানা রকম অভিযোগ এনে আমাদের বদলি করা হয়। তার বিরুদ্ধে মুখ খুললেই হয়রানির শিকার হতে হয়।

সাংবাদিকদের ওপর চাপ ও তথ্য গোপন :-
কারাগারের নানা অনিয়ম নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর কামাল হোসেন তথ্য ফাঁস হওয়া রোধে সাংবাদিকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি এক প্রধান কারারক্ষী গোপন ক্যামেরায় স্বীকার করেন যে, কারাগারের মোবাইল উদ্ধার ও অনিয়মের তথ্য বাইরে ফাঁস হওয়ায় কারা কর্তৃপক্ষ ভীত হয়ে পড়েছে। এরপরই এক সাংবাদিকের ফোন রেকর্ড বিকৃত করে দেশ টিভির প্রতিবেদকের কাছে সরবরাহ করা হয়, যাতে সত্য ঘটনা আড়াল করা যায়।

রাজনৈতিক আশ্রয় ও প্রশাসনিক প্রভাব:-
কারা অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, কামাল হোসেন ছাত্রলীগের ঘনিষ্ঠ এবং সরকারের বিশেষ মহলের আশীর্বাদপুষ্ট। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দুর্নীতিবাজ ৯৬ কর্মকর্তার তালিকায় তার নাম এলেও তিনি কৌশলে টিকে যান। এছাড়াও কারাগারে বন্দী কয়েক সাবেক এমপিদেরও দিচ্ছেন নানান শুবিধা। তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ দুদকে দাখিল হলেও রহস্যজনকভাবে সেগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়।

জনমতের প্রতিক্রিয়া ও দাবি:-
রাজশাহী মডেল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জানান, কারাগারের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে অন্তত এক ডজনের বেশি রেকর্ড তাদের হাতে রয়েছে। তিনি বলেন, “ডিআইজি প্রিজন্স কামাল হোসেনের অপকর্মের যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা দরকার।

এদিকে, কারা অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, ডিআইজি প্রিজন্স কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নতুন করে তদন্ত শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, তার বিরুদ্ধে শিগগিরই প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

এ সকল বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী কারাগারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, “এ ধরনের অভিযোগ গুরুতর। যদি সত্যি হয়, তবে এটি তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে ডিআইজি কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ডিআইজি প্রিজন্স কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ এবং তার ক্ষমতার উৎস কোথায়, তা নিয়ে আরও গভীর অনুসন্ধানের দাবি উঠেছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *