ইসলাম ও মে দিবসের ভাবনা

মুফতি এম হেদায়েত হোসাইন

১৮৮৬ সালের ১লা মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজ ও নূন্যতম বেতনের দাবিতে আন্দোলন করে এবং সে আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত ও ৪০ জনের মতো আহত হয়। ঐদিন তাদের আত্মদানের মধ্যদিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এই দিনকে তখন থেকেই সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।

প্রতিবছর মে দিবস পালন করা হয়। মিছিল, বিক্ষোভ, র‍্যালি করা হয়। করা হয় আন্দোলন। কিন্তু শ্রমিকের অধিকার কি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে? মালিক শ্রমিকের ভেদাভেদ কি দূর হচ্ছে? হচ্ছে না, কারণ একটাই। ইসলাম যে অধিকার মালিক শ্রমিককে দিয়েছে সেটা সমাজে প্রতিষ্ঠিত না থাকা।

আমরা আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি তার সবকিছুর পেছনেই রয়েছে শ্রমীকদের অবদান। আমাদের শরীরে পরিহিত পোশাকের পেছনে দর্জি শ্রমীকের অধিকার রয়েছে। আমাদের বাড়ির যে বিল্ডিং তৈরী করা হয়েছে সেটাও রাজমিস্ত্রী করেছে। এভাবে প্রত্যেকটা কাজ ও কর্মের পেছনে রয়েছে শ্রমীকের অবদান।
শ্রম সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’য়ালা বলেন, “নিশ্চয় আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি কঠোর পরিশ্রম করার জন্য।” (সূরা বালাদ:৯০/৪)

তিনি আরও বলেন, “আর যখন নামাজ শেষ হয়ে যায় তখন তোমরা রিজিকের অন্বেষণ করতে জমিনে কাজের জন্য ছড়িয়ে পড়ো, আল্লাহকে বেশি স্মরণ করো, আশা করা যায় তোমরা সফলতা অর্জন করতে পারবে।” (সূরা জুম’আ:৬২/১০)

মানুষ এই পরিশ্রম করবে বিভিন্ন ধরনের, যেমন: কেউ করবে কৃষি কাজ, কেউ হবে ভ্যান চালক, কেউ পোশাক তৈরি করবে, কেউ আবার ঘর তৈরি করবে ইত্যাদি। আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’য়ালা নিজেই এভাবে সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, “নিশ্চয় মানুষের কর্ম প্রচেষ্টা বিভিন্ন প্রকৃতির।” (সূরা লাইল:৯২/৪)

কঠোর পরিশ্রম করার মধ্যেই দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা নির্ভর করে। আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’য়ালা বলেন, “হে মানুষ! নিশ্চয় তোমার রবের নিকট পৌঁছা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে থাকো, একটার পর একটা পরিশ্রম করার ফলে তোমার রবের সাথে সাক্ষাৎ হবে।” (সূরা ইনশিক্বক:৮৪/৬)

এই পৃথিবীতে যত নাবী-রাসুলের আগমন হয়েছে তাঁরা সবাই ছিলেন শ্রমীক। হযরত আদম (আঃ) ও শিষ (আঃ) ছিলেন কৃষক, হযরত ইদ্রীস (আঃ) ছিলেন দর্জী, মূসা (আঃ) ছিলেন কৃষক, দাউদ (আঃ) ছিলেন কামার, ঈসা (আঃ) ছিলেন ডাক্তার, নুহ (আঃ) ছিলেন কাঠমিস্ত্রী, মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও তাঁর ছেলে ইসমাইল (আঃ) ছিলেন রাজমিস্ত্রী, আমাদের প্রিয় রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন রাখাল ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। এভাবে করে সকল পয়গম্বরগন (আঃ) ছিলেন শ্রমীক।

হযরত শুয়াইব (আঃ) কে তাঁর এক মেয়ে হযরত মূসা (আঃ) সম্পর্কে বলেছিলো, “হে পিতা, শ্রমীক হিসেবে আপনি তাঁকে নিযুক্ত করুন, শ্রমীক হিসেবে সেই উত্তম হবে কারণ সে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত।” (সূরা ক্বসাস:২৮/২৬)

শ্রমীকদের মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
“শ্রমীকরা হলো আল্লাহর বন্ধু”
তিনি আরও বলেন, “কিয়ামতের দিন আল্লাহ রব্বুল আলামীন নিজেই সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দিবেন যে ব্যক্তি শ্রমীকের মজুরি সঠিকভাবে দেয় না”
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তিম সময়ে জীবনের শেষ যে কথা সেটাও ছিলো “তোমরা দাস-দাসী (শ্রমীকদের) প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে”

রাসূল (সাঃ) বলেন, “ফরজ ইবাদতের পর সর্বশ্রষ্ঠ ইবাদত হলো নিজ হাতে পরিশ্রম করে আয় করা”
শ্রমীকের বেতন সম্পর্কে রহমাতুল্লিল আলামীন (সাঃ) বলেন, “শ্রমীকের শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তাদের প্রাপ্য মজুরি দিয়ে দাও”
অথচ আজকে আমাদের দেশে গার্মেন্টস শ্রমীকদের বেতনের জন্য আন্দোলন করতে হয়।
আন্দোলনের ফলাফল হয় কয়েকজন বনি আদমের লাশ।

মালিক শ্রমীক সম্পর্ক হবে ভাই ভাই কারণ প্রকৃত সম্পদের মালিক হলো আল্লাহ। আল্লাহ কাউকে কিছু সময়ের জন্য ভোগ করতে দিয়েছেন মাত্র।
রাসূল (সাঃ) বলেন, তোমরা সবাই আদমের সন্তান আর আদম মাটির তৈরি, কে সাদা আর কে কালো, কে ধনি কে গরিব, এগুলো যতদিন আমরা দূর করতে না পারবো ততদিন মালিক শ্রমীকের বন্ধুত্ব সূলভ আচরণ সম্ভব নয়।

এজন্য আমরা যদি ‘সবাই এক আল্লাহর গোলাম’ এই নীতির আলোকে জীবন গড়তে পারি তাহলে মালিক শ্রমীক ভেদাভেদ দূর হবে, ভাই ভাই সম্পর্ক গড়ে উঠবে। অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে মালিক শ্রমীক উভয়ের।

আমরা সবাই এক আল্লাহর গোলাম পরিচয় দিয়ে আগামীর দিন যেন সুন্দর করে সাজাতে পারি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আ-মীন।

সভাপতি, কৃষিজীবি শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন, নড়াইল জেলা।
সেক্রেটারি, কৃষিজীবি শ্রমিক ইউনিয়ন নড়াইল জেলা ও বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন নড়াইল সদর উপজেলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *