
অরবিন্দ রায়, স্টাফ রিপোর্টারঃ
গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (গাকৃবি) কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রখ্যাত প্রজননবিদ অধ্যাপক ড. নাসরীন আক্তার আইভীর নেতৃত্বে গবেষণার মাধ্যমে সম্প্রতি উদ্ভাবিত হয়েছে একটি নতুন ধানের জাত ‘জিএইউ ধান-৩’। ধানের এই জাতটির উদ্ভাবন গাকৃবির গবেষণায় এক নতুন মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রিমিয়াম কোয়ালিটির এই নতুন জাতটি সুগন্ধিযুক্ত ও জিঙ্ক সমৃদ্ধ হওয়ায় পুষ্টি ও মানের দিক থেকে এটি একটি ব্যতিক্রমী সংযোজন হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এ জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে গাকৃবির মোট উদ্ভাবিত জাতের সংখ্যা ৯০টি তে পৌঁছালো যা বাংলাদেশের কৃষিতে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করলো।
গাকৃবি সূত্র জানায়, গবেষণা মাঠে দীর্ঘ ৪ বছর গবেষণা ও ফলন পরীক্ষার পর ২০২১ ও ২০২২ সালে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ জাতটি মাঠে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পরবর্তীতে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী কর্তৃক প্রস্তাবিত ফলন পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফলাফলের সুপারিশের প্রেক্ষিতে জাতীয় বীজ বোর্ড গত ২০ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে এ জিএইউ ধান-৩ এর ছাড়পত্র দেয়। এ ধানে আধুনিক উফশী ধানের সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। চালে অধিক জিঙ্ক এবং লৌহ রয়েছে যা মানুষের শরীরকে একদিকে যেমন রোগ প্রতিরোধী করে জীবাণু ও ভাইরাস থেকে রক্ষা করে তেমনি শরীরে হিমোগোবিন তৈরির মাধ্যমে শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে। দানা চিকন ও লম্বা এ জিএইউ ধান-৩ তুলনামূলক কম সময়ের মধ্যে পরিপক্ব হয়। আমনমৌসুমে প্রায় ৩ মাস এবং বোরো মৌসুমে সাড়ে ৩ মাস পর উৎপাদন পাওয়া যায়। ফলে অল্প সময়ে অধিক ফলন পেয়ে কৃষকরা লাভবান হতে পারেন। অন্যদিকে এ ধানের গাছের আকার বড়, কান্ড মোটা ও কুশির সংখ্যা বেশি হওয়ায় এটি থেকে অধিক পরিমাণ খড় পাওয়া যায়। এতে গবাদি পশুর খাদ্য চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
জানা গেছে, সাধারণ জাতের তুলনায় এটি গড়ে ১৫% বেশি ফলন দিতে সক্ষম যা বাংলাদেশের মতো ধান নির্ভর কৃষিভিত্তিক দেশে এর উপযোগিতা অনেক। উৎকৃষ্টমানের এ জাতের ফলন হেক্টর প্রতি সাড়ে ৫ টন থেকে ৬ টন যা একে অন্যান্য জাতের ধান থেকে বিশেষ স্থানে নিয়ে গিয়েছে। এতে উপস্থিত অ্যামাইলেজ নামক এনজাইমের পরিমাণ শতকরা ২৬ ভাগ যা শরীরে শর্করা জাতীয় খাবারগুলোকে সহজে ভেঙে শরীরে শক্তি সরবরাহ ও হজম প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। আবার সাধারণ চালের তুলনায় এতে জিঙ্কের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি, যা শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। সুবাসযুক্ত ধানটি রান্নার সময় মনোহর সুবাস ছড়ায় ফলে ভোক্তাদের কাছে এর চাহিদা বাড়াবে। এছাড়া জলবায়ু সহনশীলতা ও রোগ-পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকায় এটি দেশের বৈচিত্র্যময় পরিবেশে চাষের জন্য উপযোগী ও লাভজনক একটি জাত।
এ বিষয়ে জিএইউ ধান-৩ এর উদ্ভাবক ড. আইভী বলেন,“আজকের বিশ্বে খাদ্যের পরিমাণের পাশাপাশি গুণগত মানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অপুষ্টি ও খনিজ ঘাটতি দূর করতে জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবন একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। জিএইউ ধান-৩ কেবল একটি নতুন জাত নয়, এটি পুষ্টি, উৎপাদন ও কৃষকের আর্থিক উন্নয়নের মাঝে একটি শক্ত সেতুবন্ধন। রপ্তানীযোগ্য এই জাতের মাধ্যমে দেশে পুষ্টিনির্ভর কৃষি বিপ্লবের সুস্পষ্ট সূচনা হয়েছে বলেও তিনি অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন ।”
গাকৃবির ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. জিকেএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,“জিএইউ ধান-৩ শুধু একটি জাত নয়, এটি আমাদের কৃষি গবেষণার গৌরবময় প্রতীক। ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির জন্য এটি অপরিসীম অবদান রাখবে।”