আগামীকাল পবিত্র ঈদুল আজহাঃ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত আত্মশুদ্ধি ও ভ্রাতৃত্ববোধে সামাজিক সংহতি

সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার- জাহারুল ইসলাম জীবন।

আগামীকাল ১০ই জিলহজ্ব, সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ মহান ঈদুল আজহা উদযাপন করবে। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে, ঈদের নামাজ আদায়ের পর শুরু হবে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত কোরবানির আনুষ্ঠানিকতা। এই মহৎ ত্যাগের উৎসব শুধু একটি প্রথা নয়, বরং এটি মানব ইতিহাসের গভীরতম আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক তাৎপর্য বহন করে। কোরআন ও হাদিসের আলোকে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সাথে সমসাময়িক বিশ্ব পরিস্থিতির মেলবন্ধন ঘটিয়ে আমরা ঈদুল আজহার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব।
** কোরআন ও হাদিসের আলোকে কোরবানিঃ-
কোরবানি শব্দের আভিধানিক অর্থ নৈকট্য অর্জন বা উৎসর্গ। ইসলামিক পরিভাষায়, আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট পশুর রক্ত প্রবাহিত করাকে কোরবানি বলে। এর মূল ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে নবী ইব্রাহিম (আঃ)-এর মহান ত্যাগের উপর।
** সূরা সাফফাত, আয়াত (১০২-১০৭)-
এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা’আলা ইব্রাহিম (আঃ)-এর স্বপ্ন এবং তাঁর পুত্র ইসমাইল (আঃ)-কে কোরবানি করার নির্দেশ প্রদানের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহর নির্দেশ পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং ইসমাইল (আঃ)-ও নিজেকে কোরবানির জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় শেষ মুহূর্তে ইসমাইল (আঃ)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হয়। এই ঘটনা মানবজাতির জন্য ত্যাগের এক অনন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
** হাদিস শরীফঃ- রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “কোরবানির দিন আদম সন্তানের কোনো আমল আল্লাহ তা’আলার কাছে রক্ত প্রবাহিত করা থেকে অধিক প্রিয় নয়।” (তিরমিযী) এই হাদিস কোরবানির গুরুত্ব ও ফজিলতকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এটি প্রমাণ করে যে, কোরবানি কেবল একটি বাহ্যিক কর্ম নয়, বরং এটি আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্য ও ভালোবাসার প্রকাশ।
** ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও সমসাময়িক বিশ্বঃ-
ইব্রাহিম (আঃ)-এর এই মহান আত্মত্যাগ মানব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। তৎকালীন সমাজে প্রতিমা পূজা এবং আত্মপূজা যখন প্রবল ছিল, তখন ইব্রাহিম (আঃ) এক আল্লাহর প্রতি অবিচল আনুগত্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর এই ত্যাগের মাধ্যমে তিনি শিরক ও প্রবৃত্তিপূজার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বার্তা দিয়েছিলেন।
আজকের বিশ্বে আমরা একদিকে যেমন অর্থনৈতিক বৈষম্য, সংঘাত, বর্ণবাদ এবং মানবিক সংকটের মুখোমুখি, তেমনি অন্যদিকে ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা এবং ভোগবাদের প্রবণতাও প্রবল। এমন পরিস্থিতিতে ঈদুল আজহা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ত্যাগের মহত্ত্ব, পরোপকার এবং আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতার কথা।
** ফিলিস্তিন সংকটঃ- বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ফিলিস্তিন সংকট। গাজা উপত্যকায় নিরন্তর গণহত্যা, নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ এবং মৌলিক অধিকার হরণ বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। ঈদুল আজহার ত্যাগের শিক্ষা আমাদেরকে ফিলিস্তিনি ভাই-বোনদের পাশে দাঁড়ানোর এবং তাদের মুক্তির জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করার অনুপ্রেরণা যোগায়।
** বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাঃ- বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্যস্ফীতি এবং কর্মসংস্থান সংকট বহু মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, কোরবানির মাংস অভাবী ও দরিদ্রদের মাঝে বিতরণের মাধ্যমে আমরা সামাজিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করতে পারি।
** পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনঃ- পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের জন্য এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ। ঈদুল আজহার সময় পশু কোরবানির পর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবেশ সচেতনতা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঠিক প্রয়োগ এই উৎসবকে আরও পরিবেশবান্ধব করে তুলতে পারে।
** ত্যাগের মহিমা ও ব্যক্তিগত পরিশুদ্ধিঃ-
কোরবানি কেবল পশু কোরবানির নাম নয়, বরং এটি আমাদের ভেতরের পশুত্বকে কোরবানি দেওয়ার নাম। হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার, লোভ, কাম, ক্রোধ – এই সমস্ত আত্মিক ব্যাধিকে বিসর্জন দিয়ে আত্মশুদ্ধি অর্জন করাই কোরবানির মূল উদ্দেশ্য। এটি আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের এক অসাধারণ উপায়। ব্যক্তিগত জীবনে ত্যাগের অভ্যাস গড়ে তোলা, অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করার মানসিকতাই কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা।
সর্বপরি, ঈদুল আজহা আমাদের জন্য এক নব প্রেরণা, এক নতুন দিগন্ত। এটি শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি মানবতা, শান্তি, এবং ত্যাগের এক শক্তিশালী বার্তা। কোরআন ও হাদিসের আলোকে এবং সমসাময়িক বিশ্বের বাস্তবতার নিরিখে এই উৎসবের তাৎপর্য অনুধাবন করা আমাদের জন্য অপরিহার্য। আসুন, এই ঈদুল আজহায় আমরা শুধু পশু কোরবানি না করে, নিজেদের ভেতরের সকল কলুষিত পাপিও কালিমা দূর করে আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করি। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের কোরবানি কবুল করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্য ও সমৃদ্ধি দান করেন- আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *