ড. মুহাম্মদ ইউনুস: এক স্বপ্নবান সাধকের সাহসী পদচারণা

মোঃ মকবুলার রহমান, স্টাফ রিপোর্টার

শৈশবে কেউ বলেনি— “এই ছেলেটি একদিন নোবেল পুরস্কার জিতবে।”
কেউ কল্পনাও করেনি, তাঁর চিন্তাভাবনাই একদিন বদলে দেবে বৈশ্বিক অর্থনীতির ধারা।
তাঁর শৈশব কেটেছে চট্টগ্রামের এক শান্ত, নির্জন গ্রামে—
সাদামাটা, কিন্তু গভীর কোনো স্বপ্নে মোড়ানো এক জীবনযাপন।
তাঁর চোখে ছিল প্রশ্নের ঝলক, মনে ছিল এক অদম্য কৌতূহল:
“দারিদ্র্য মানুষের জীবনকে এত অসহায় করে তোলে কেন?”

এই একটিমাত্র প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই শুরু হয়েছিল তাঁর জীবনের ব্যতিক্রমী যাত্রা।

জ্ঞানপিপাসা তাঁকে পৌঁছে দেয় আমেরিকার উচ্চতর শিক্ষাঙ্গনে,
অর্থনীতির জটিল সূত্র বুঝতে গিয়ে তিনি অনুধাবন করেন,
গণমানুষের জীবন বদলানোর চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে এই জ্ঞানের গভীরে।
চাইলেই তিনি বিলাসবহুল জীবন বেছে নিতে পারতেন বিদেশে,
কিন্তু তাঁর হৃদয়ের টান ছিল দেশের মাটির প্রতি—
এক যুদ্ধবিধ্বস্ত, দারিদ্র্যক্লিষ্ট, তবু সম্ভাবনায় ভরপুর মাতৃভূমির প্রতি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন,
শুধু বইয়ের পাতায় সমাজের পরিবর্তন সম্ভব নয়।
প্রকৃত পরিবর্তন আসে তখনই, যখন একজন মানুষ
নিজে নেমে আসেন বাস্তবতার মাটিতে, ছুঁয়ে দেখেন মানুষের দুঃখ-বেদনা।

তিনি গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেছেন, মানুষের ঘরে গিয়েছেন,
আলাপ করেছেন দরিদ্রদের সঙ্গে, শুনেছেন তাঁদের নিঃশব্দ কান্না।
একদিন দেখলেন—কয়েকজন নারী মাত্র ৩০-৫০ টাকার জন্য
নিজের শ্রম আর স্বাধীনতা বিকিয়ে দিচ্ছেন সুদখোরদের কাছে।
তাঁদের পরিশ্রম, ঘাম, স্বপ্ন—সবই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ঋণের দোহাইয়ে।

সেদিন তিনি থেমে থাকেননি।
তিনি করলেন এক ‘অসম্ভব’ কাজ—নিজের পকেট থেকে দিলেন মাত্র ৮৫ টাকা।
৪২ জন নারী সে টাকায় শুরু করলেন নিজ নিজ উদ্যোগ।
কেউ বাঁশের তৈরি সামগ্রী বানালেন, কেউ হাঁস-মুরগি পাললেন, কেউ চাল কিনে বিক্রি করলেন।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য—এক টাকাও বাকী রাখেননি কেউ।

এই ক্ষুদ্র ঘটনাই রচনা করল ইতিহাসের নতুন অধ্যায়—গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম।

এটি ছিল এমন এক ব্যাংক, যেখানে দরিদ্র, নিরক্ষর, প্রান্তিক মানুষরাই ছিল মুখ্য।
যেখানে ব্যাংকিং অর্থনীতি আর বিলাসিতার প্রতীক নয়, বরং আত্মমর্যাদার এক হাতিয়ার।
ড. ইউনুস প্রমাণ করলেন, দরিদ্ররাও ঋণ নিতে পারে,
ঋণ শোধ করতে পারে, এমনকি নিজের ভাগ্যও গড়ে নিতে পারে।

গ্রামীণ ব্যাংক শুধু অর্থায়ন করেনি,
মানুষকে দিয়েছে সাহস, স্বপ্ন ও আত্মবিশ্বাস।
নারীর ক্ষমতায়নে এনেছে এক নিঃশব্দ বিপ্লব—
৯৭ শতাংশ ঋণগ্রহীতা নারী, যারা আগে নিজের নামে দশ টাকাও ধার নেননি,
তাঁরাই আজ ক্ষুদ্র ব্যবসার সাহসী উদ্যোক্তা।

বিশ্ব তখন বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল—
কে এই মানুষ? কীভাবে তিনি ভেঙে দিলেন দারিদ্র্যের শিকল?

২০০৬ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনুস ও গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে অর্জন করলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার।
এই সম্মান শুধু একজন ব্যক্তির নয়—এ ছিল একটি দেশের, একটি স্বপ্নের স্বীকৃতি।
তাঁর Social Business মডেল আজ বিশ্বজুড়ে অনুসরণীয় উদাহরণ।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পড়ায় তাঁর ভাবনা, সরকারগুলো খোঁজে তাঁর পরামর্শ।

তবুও এই পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না।
দেশি-বিদেশি সমালোচনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অপপ্রচারের পাহাড়—সবকিছু পেরিয়ে তিনি টিকেছিলেন।
কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিল স্পষ্ট:
মানবতার পক্ষে যে কাজ, তাকে কোনো বাধাই চিরকাল থামিয়ে রাখতে পারে না।

আজ তিনি শুধুই একজন নোবেলজয়ী নন,
তিনি টেকসই উন্নয়নের পরামর্শদাতা, সমাজ পরিবর্তনের পুরোধা,
আর আমাদের প্রত্যেকের জন্য এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা।

তাঁর জীবন আমাদের বলে—
সমস্যাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলে সমাজ বদলাবে না।
একটি মানুষ, একটি সিদ্ধান্ত, একটি সাহসী পদক্ষেপই
বদলে দিতে পারে একটি দেশ, এমনকি পুরো পৃথিবী।

তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—
“তুমি যেখানেই থাকো, সেখান থেকেই শুরু করো।”
তোমার ভেতরেই আছে সেই শক্তি, যে শক্তি একদিন ইতিহাস লিখে যেতে পারে।

ড. ইউনুস আমাদের দেখিয়েছেন—
স্বপ্ন শুধু দেখা যায় না, স্বপ্নকে স্পর্শও করা যায়, যদি তাতে কাজের আগুন জ্বলতে থাকে।
তাঁর জীবনের দিকে তাকাও। ভাবো—তুমিও একদিন হয়ে উঠতে পারো
একটি অনুপ্রেরণার গল্প।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *